Devdas Bangla Text
একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখুয্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া, শ্লেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা ছড়াইয়া, হাই তুলিয়া, অবশেষে হঠাৎ খুব চিন্তাশীল হইয়া উঠিল; এবং নিমিষে স্থির করিয়া ফেলিল যে, এই পরম রমণীয় সময়টিতে মাঠে মাঠে ঘুড়ি উড়াইয়া বেড়ানোব পরিবর্ত্তে পাঠশালায় আবদ্ধ থাকাটা কিছু নয়। উর্ব্বর মস্তিষ্কে একটা উপায়ও গজাইয়া উঠিল। সে শ্লেট-হাতে উঠিয়া দাড়াইল।
পাঠশালায় এখন টিফিনের ছুটি হইয়াছিল। বালকের দল নানারূপ ভাব-ভঙ্গী ও শব্দ-সাড়া করিয়া অনতিদূরের বটবৃক্ষতলে ডাংগুলি খেলিতেছিল। দেবদাস সেদিকে একবার চাহিল। টিফিনের ছুটি সে পায় না—কেননা গোবিন্দ পণ্ডিত অনেকবার দেখিয়াছেন যে, একবার পাঠশালা হইতে বাহির হইয়া পুনরায় প্রবেশ করাটা দেবদাস নিতান্ত অপছন্দ করে। তাঁহার পিতারও নিষেধ ছিল। নানা কারণে ইহা স্থির হইয়াছিল যে, এই সময়টিতে সে সর্দ্দার-পোড়ো ভুলোর জিম্মায় থাকিবে।
এখন ঘরের মধ্যে শুধু পণ্ডিত মহাশয় দ্বিপ্রাহরিক আলস্যে চক্ষু মুদিয়া শয়ন করিয়াছিলেন, এবং সর্দ্দার-পোড়ো ভুলো, এক কোণে হাত-পা-ভাঙ্গা একখণ্ড বেঞ্চের উপর ছোট-খাটো পণ্ডিত সাজিয়া বসিয়াছিল এবং মধ্যে মধ্যে নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কখনও বা খেলা দেখিতেছিল, কখনও বা দেবদাস এবং পার্ব্বতীর প্রতি আলস্য-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছিল। পার্ব্বতী এই মাসখানেক হইল পণ্ডিত মহাশয়ের আশ্রয়ে এবং তত্ত্বাবধানে আসিয়াছে। পণ্ডিত মহাশয় সম্ভবতঃ এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাহার একান্ত মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন, তাই সে নিবিষ্ট মনে, নিরতিশয় ধৈর্য্যের সহিত সুপ্ত পণ্ডিতের প্রতিকৃতি বোধোদয়ের শেষ পাতাটির উপর কালি দিয়া লিখিতেছিল এবং দক্ষ চিত্রকরেব ন্যায় নানাভাবে দেখিতেছিল যে, তাহার বহু যত্নের চিত্রটি আদর্শের সহিত কতখানি মিলিয়াছে। বেশী যে মিল ছিল তাহা নয়; কিন্তু পার্ব্বতী ইহাতেই যথেষ্ট আনন্দ ও আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিতেছিল।
এই সময় দেবদাস শ্লেট-হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ভুলোর উদ্দেশে ডাকিয়া বলিল, অঙ্ক হয় না।
ভুলো শান্ত-গম্ভীর মুখে কহিল, কি আঁক?
মণকষা-
শেলেটটা দেখি-
ভাবটা এই যে তাহার নিকট এসব কাজে শ্লেটখানি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র! দেবদাস তাহার হাতে শ্লেট দিয়া নিকটে দাঁড়াইল। ভুলো ডাকিয়া লিখিতে লাগিল যে, এক মন তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা ন আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে-
এমনি সময়ে একটি ঘটনা ঘটিল।—হাত-পা-ভাঙ্গা বেঞ্চিখানার উপর সর্দার- পোড়ো তাহার পদমর্যাদার উপযুক্ত আসন নির্বাচন করিয়া যথানিয়মে আজ তিন বৎসর ধরিয়া প্রতিদিন বসিয়া আসিতেছে। তাহার পশ্চাতে একরাশ চুন গাদা করা ছিল। এটি পণ্ডিত মহাশয় কবে কোন যুগে নাকি সস্তা-দরে কিনিয়া রাখিয়া-ছিলেন; মানস ছিল, সময় ভাল হইলে ইহাতে কোঠা-দালান দিবেন। কবে যে সে শুভদিন আসিবে তাহা জানি না, কিন্তু এই শ্বেত-চূর্ণের প্রতি তাঁহার সতর্কতা এবং যত্নের অবধি ছিল না। সংসারানভিজ্ঞ অপরিণামদর্শী কোন অলক্ষ্মী-অশ্রিত বালক ইহার রেণুমাত্র নষ্ট না করিতে পারে, সেইজন্য প্রিয়পাত্র এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভোলানাথ এই সযত্নে-সঞ্চিত বস্তুটি সাবধানে রক্ষা করিবার ভার পাইয়াছিল এবং সে বেঞ্চের উপর বসিয়া ইহাকে আগুলিয়া থাকিত।
ভোলনাথ লিখিতেছিল,—এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলেও গো বাবা গো-তাহার পর খুব শব্দ-সাড়া হইল। পার্বতী ভয়ানক উচ্চকঠে চেঁচাইয়া হাততালি দিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। সদ্যানিদ্রোদ্বিত গোবিন্দ পণ্ডিত রক্তনেত্রে একেবারে উঠিয়া দাড়াইলেন। দেখিলেন, গাছতলায় ছেলের দল একেবারে সার বঁধিয়া হৈ হৈ শব্দে ছুটিয়া চলিতেছে এবং তখনি চক্ষে পড়িল যে, ভগ্ন বেঞ্চের উপর একজোড়া পা নাচিয়া বেড়াইতেছে এবং চুনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্নেউপাত হইতেছে। চীৎকার করিলেন, কি-কি–কি রে।
বলিবার মধ্যে শুধু পার্বতী ছিল। কিন্তু সে ভূবন ভূমিতলে লুটাইতেছে এবং করতালি দিতেছে। পণ্ডিত মহাশয়ের বিফল প্রশ্ন ক্রুদ্ধভাবে ফিরিয়া গেল, কি, কি-কি রে।
তাহার পর শ্বেতমূর্ত্তি ভোলানাথ চুন ঠেলিয়া উঠিয়া দাড়াইল। পণ্ডিতমহাশয় আবার চীৎকার করিলেন, গুয়োটা তুই।—তুই ওর ভেতর।
অ্যাঁ—অ্যাঁ—অ্যাঁ—
আবার!-
দেবা শালা-ঠেলে-অ্যাঁ-অ্যাঁ-মণকষা-
আবার গুঁয়োটা!
কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া, মাদুরের উপব উপবেশন করিয়া প্রশ্ন করিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে দিয়ে পালিয়েছে?
ভুলো আরো কাঁদিতে লাগিল—অ্যাঁ—অ্যাঁ—অ্যাঁ—
তাহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া চুন ঝাড়াঝাড়ি হইল, কিন্তু সাদা এবং কালো রঙে সর্দার-পোড়োকে কতকটা ভূতের মতো দেখাইতে লাগিল এবং তখনও তাহার ক্রন্দনের নিবৃত্তি হইল না।
পণ্ডিত বলিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে পালিয়েচে? বটে?
ভুলো বলিল—অ্যাঁ—অ্যাঁ—
পণ্ডিত বলিলেন, এর শোধ নেব।
ভুলো কহিল,—অ্যাঁ—অ্যাঁ—অ্যাঁ—
পণ্ডিত প্রশ্ন করিলেন, ছোঁড়াটা কোথায়—
তাহার পর ছেলেদের দল রক্তমুখে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, দেবাকে ধরা গেল না। উঃ—যে ইঁট ছোঁড়ে—!
ধরা গেল না?
আর একজন বালক পূর্বকথার প্রতিধ্বনি করিল—উঃ—যে—
থাম বেটা—
সে ঢোক গিলিয়া একপাশে সরিয়া গেল। নিষ্ফল-ক্রোধে পণ্ডিতমশাই প্রথমে পার্ব্বতীকে খুব ধমকাইয়া উঠিলেন; তাহার পর ভোলানাথের হাত ধরিয়া কহিলেন, চল্, একবার কাছারিবাড়িতে কর্তাকে বলে আসি।
ইহার অর্থ এই যে, জমিদার নারায়ণ মুখুয্যের নিকট তাঁহার পুত্রের আচরণের নালিশ করিবেন।
তখন বেলা তিনটা আন্দাজ হইয়াছিল। নারায়ণ মুখুয্যেমশায় বাহিরে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক খাইতেছিলেন এবং একজন ভৃত্য হাত-পাখা লইয়া বাতাস করিতেছিল। সছাত্র পণ্ডিতের অসময় আগমনে কিছু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, গোবিন্দ যে!
গোবিন্দ জাতিতে কায়স্থ—ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া ভুলোকে দেখাইয়া সমস্ত কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। মুখুয্যেমশায় বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, তাইত, দেবদাস যে শাসনের বাইরে গেছে দেখচি!
কি করি, আপনি হুকুম করুন।
জমিদারবাবু নলটা রাখিয়া দিয়া কহিলেন, কোথা গেল সে?
তা কি জানি? যারা ধরতে গিয়েছিল, তাদের ইঁট মেরে তাড়িয়েচে।
তাঁহারা দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। নারায়ণবাবু বলিলেন, বাড়ি এলে যা হয় করব।
গোবিন্দ ছাত্রের হাত ধরিয়া পাঠশালায় ফিরিয়া গিয়া মুখ ও চোখের ভাব-ভঙ্গীতে সমস্ত পাঠশালা সন্ত্রাসিত করিয়া তুলিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, দেবদাসের পিতা সে অঞ্চলের জমিদার হইলেও তাহাকে আর পাঠশালে ঢুকিতে দিবেন না। সেদিন পাঠশালার ছুটি কিছু পূর্বেই হইল; যাইবার সময় ছেলেরা অনেক কথা বলাবলি করিতে লাগিল।
একজন কহিল, উঃ! দেবা কি ষণ্ডা দেখেচিস!
আর একজন কহিল, ভুলোকে আচ্ছা জব্দ করেচে।
উঃ, কি ঢিল ছোঁড়ে!
আর একজন ভুলোর তরফ হইতে কহিল,—ভুলো শোধ নেবে দেখিস।
ইস্—সে তো আর পাঠশালায় আসবে না যে শোধ নেবে।
এই ক্ষুদ্র দলটির একপাশে পার্ব্বতীয় বই-শ্লেট লইয়া বাড়ি আসিতেছিল। সে নিকটবর্তী একজন ছেলের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মণি, দেবদাদাকে আর পাঠশালায় সত্যি আসতে দেবে না?
মণি বলিল, না—কিছুতেই না।
পার্ব্বতী সরিয়া গেল—কথাটা তার বরাবরই ভাল লাগে নাই।
পার্ব্বতীর পিতার নাম নীলকণ্ঠ চক্রবর্তী। চক্রবর্তী মহাশয় জমিদারদের প্রতিবেশী অর্থাৎ মুখুয্যে মহাশয়ের খুব বড় বাড়ির পার্শ্বে তাঁহার ছোট এবং পুরাতন সেকেলে ইঁটের বাড়ি। তাঁহার দু-দশ বিঘা জমিজমা আছে, দু’-চার ঘর যজমান আছে, জমিদারবাড়ির আশা-প্রত্যাশাটা আছে,—বেশ স্বচ্ছন্দ পরিবার—বেশ দিন কাটে।
প্রথমে ধর্ম্মদাসের সহিত পার্ব্বতীর সাক্ষাৎ হইল। সে দেবদাসের বাটীর ভৃত্য। এক বৎসর বয়স হইতে আজ দ্বাদশ বর্ষ বয়স পর্যন্ত তাহাকে লইয়াই আছে—পাঠশালায় পৌঁছিয়া দিয়া আসে এবং ছুটির সময় সঙ্গে করিয়া বাটী ফিরাইয়া আনে। এ কাজটি সে যথানিয়মে প্রত্যহ করিয়াছে এবং আজিও সেইজন্যই পাঠশালায় যাইতেছিল। পার্ব্বতীরকে দেখিয়া কহিল, কৈ পারু, তোর দেবদাদা কোথায়?
পালিয়ে গেছে—
ধর্ম্মদাস ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া বলিল, পালিয়ে গেছে কি রে?
তখন পার্ব্বতীর ভোলানাথের দুর্দশার কথা মনে করিয়া আবার নূতন করিয়া হাসিতে শুরু করিল,—দেখ্ ধম্ম, দেবদা—হি হি হি—একেবারে চুনের গাদায়—হি হি—হু হু—একেবারে ধম্ম চিৎ করে—
ধর্ম্মদাস সব কথা বুঝিতে না পারিলেও হাসি দেখিয়া খানিকটা হাসিয়া লইল; পরে হাস্য সংবরণ করিয়া জিদ করিয়া কহিল, বল না পারু, কি হয়েচে?
দেবদা ঠেলে ফেলে দিয়ে—ভুলোকে—চুনের গাদায়—হি হি হি—
ধর্ম্মদাস এবার বাকিটা বুঝিয়া লইল এবং অতিশয় চিন্তিত হইল; বলিল, পারু সে এখন কোথায় আছে জানিস?
আমি কি জানি!
তুই জানিস—বলে দে। আহা তার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েচে।
তা তো পেয়েচে—আমি কিন্তু বলব না।
কেন বলবি নে?
বললে আমাকে বড় মারবে। আমি খাবার দিয়ে আসবো।
ধর্ম্মদাস কতকটা সন্তুষ্ট হইল—কহিল, তা দিয়ে আসিস, আর সন্ধ্যের আগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি ডেকে আনিস।
আনব।
বাটীতে আসিয়া পার্ব্বতীর দেখিল, তাহার মা এবং দেবদাসের মা উভয়েই সব কথা শুনিয়াছেন। তাহাকেও একথা জিজ্ঞাসা করা হইল। হাসিয়া গম্ভীর হইয়া সে যতটা পারিল কহিল। তাহার পর আঁচলে মুড়ি বাঁধিয়া জমিদারদের একটা আমবাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। বাগানটা তাহাদেরই বাটীর নিকটে, এবং ইহারই একান্তে একটা বাঁশঝাড় ছিল। সে জানিত, লুকাইয়া তামাক খাইবার জন্য দেবদাস এই বাঁশঝাড়ের মধ্যে কতকটা স্থান পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিল। পলাইয়া লুকাইয়া থাকিতে হইলে ইহাই তাহার গুপ্তস্থান। ভিতরে প্রবেশ করিয়া পার্ব্বতী দেখিল, বাঁশঝোপের মধ্যে দেবদাস ছোট একটা হুঁকা হাতে বসিয়া আছে এবং বিজ্ঞের মতো ধূমপান করিতেছে। মুখখানা বড় গম্ভীর—যথেষ্ট দুর্ভাবনার চিহ্ন তাহাতে প্রকাশ পাইতেছে। পার্ব্বতরকে দেখিতে পাইয়া সে খুব খুশী হইল, কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করিল না। তামাক টানিতে টানিতে গম্ভীরভাবেই কহিল, আয়।
পার্ব্বতী কাছে আসিয়া বসিল। আঁচলে যাহা বাঁধা ছিল, তৎক্ষণাৎ দেবদাসের চক্ষে পড়িল। কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সে তাহা খুলিয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া কহিল, পারু, পণ্ডিতমশাই কি বললে রে?
জ্যাঠামশায়ের কাছে বলে দিয়েচে।
দেবদাস হুঁকা নামাইয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, বাবাকে বলে দিয়েচে?
হ্যাঁ।
তারপর?
তোমাকে আর পাঠশালায় যেতে দেবে না।
আমি পড়তেও চাই না।
এই সময়ে তাহার খাদ্যদ্রব্য প্রায় ফুরাইয়া আসিল, দেবদাস পার্ব্বতীর মুখপানে চাহিয়া বলিল, সন্দেশ দে।
সন্দেশ তো আনিনি।
তবে জল দে।
জল কোথায় পাব?
বিরক্ত হইয়া দেবদাস কহিল, কিছুই নেই, তো এসেচিস কেন? যা, জল নিয়ে আয়।
তাহার রুক্ষস্বর পার্ব্বতীর ভাল লাগিল না; কহিল, আমি আবার যেতে পারিনে—তুমি খেয়ে আসবে চল।
আমি কি এখন যেতে পারি?
তবে কি এইখানেই থাকবে?
এইখানে থাকব, তারপর চলে যাব—
পার্ব্বতরর মনটা খারাপ হইয়া গেল। দেবদাসের আপাত-বৈরাগ্য দেখিয়া এবং কথাবার্তা শুনিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছিল,—কহিল, দেবদা, আমিও যাব-
কোথায়? আমার সঙ্গে? দূর—তা কি হয়?
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া কহিল, যাবই—
না,—যেতে হবে না—তুই আগে জল নিয়ে আয়—
পার্ব্বতী আবার মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি যাবই—
আগে জল নিয়ে আয়—
আমি যাব না—তুমি তা হলে পালিয়ে যাবে।
না—যাব না।
কিন্তু পার্ব্বতী কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিল না, তাই বসিয়া রহিল। দেবদাস পুনরায় হুকুম করিল, যা বলচি।
আমি যেতে পারব না।
রাগ করিয়া দেবদাস পার্ব্বতীর চুল ধরিয়া টান দিয়া ধমক দিল—যা বলচি।
পার্ব্বতী চুপ করিয়া রহিল। তারপর তাহার পিঠে একটা কিল পড়িল—যাবিনে?
পার্ব্বতী কাঁদিয়া ফেলিল—আমি কিছুতেই যাব না।
দেবদাস একদিকে চলিয়া গেল। পার্ব্বতীও কাঁদিতে কাঁদিতে একেবারে দেবদাসের পিতার সুমুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। মুখুয্যেমশাই পার্ব্বতীকে বড় ভালবাসিতেন। বলিলেন, পারু, কাঁদচিস কেন মা?
দেবদা মেরেচে।
কোথায় সে?
ঐ বাঁশবাগানে বসে তামাক খাচ্ছিল।
একে পণ্ডিত মহাশয়ের আগমন হইতেই তিনি চটিয়া বসিয়া ছিলেন—এখন এই সংবাদটা তাঁহাকে একেবারে অগ্নিমূর্তি করিয়া দিল। বলিলেন, দেবা বুঝি আবার তামাক খায়?
হ্যাঁ খায়, রোজ খায়। বাঁশবাগানে তার হুঁকো নুকোন আছে—
এতদিন আমাকে বলিসনি কেন?
দেবদাদা মারবে বলে।
কথাটা কিন্তু ঠিক তাই নহে। প্রকাশ করিলে দেবদাস পাছে শাস্তি ভোগ করে, এই ভয়ে সে কোন কথা বলে নাই। আজ কথাটা শুধু রাগের মাথায় বলিয়া দিয়াছে। এই তাহার সবে আট বৎসরমাত্র বয়স—রাগ এখন বড় বেশী; কিন্তু তাই বলিয়া তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা নিতান্ত কম ছিল না। বাড়ি গিয়া বিছানায় শুইয়া অনেকক্ষণ কাঁদিয়া-কাটিয়া ঘুমাইয়া পড়িল,—সে রাত্রে ভাত পর্য্যন্ত খাইল না।
দুই
দেবদাসকে পরদিন খুব মারধর করা হইল,—সমস্তদিন ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইল। তাহার পর, তাহার জননী যখন ভারী কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন, তখন দেবদাসকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল।পরদিন ভোরবেলায় সে পলাইয়া আসিয়া পার্ব্বতীর ঘরের জানালার নিকট দাঁড়াইল—ডাকিল, পারু! আবার ডাকিল, পারু!
পার্ব্বতী জানালা খুলিয়া কহিল, দেবদা!
দেবদাস ইশারা করিয়া বলিল, শিগগির আয়। দু’জনে একত্র হইলে দেবদাস বলিল, তামাক খাবার কথা বলে দিলি কেন?
তুমি মারলে কেন?
তুই জল আনতে গেলি না কেন?
পার্ব্বতী চুপ করিয়া রহিল।
দেবদাসস বলিল, তুই বড় গাধা—আর যেন বলে দিসনে।
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
তবে চল্, ছিপ কেটে আনি। আজ বাঁধে মাছ ধরতে হবে।
বাঁশঝাড়ের নিকট একটা নোনা গাছ ছিল, দেবদাস তাহাতে উঠিয়া পড়িল। বহুকষ্টে একটা বাঁশের ডগা নোয়াইয়া পার্ব্বতীকে ধরিতে দিয়া কহিল, দেখিস যেন ছেড়ে দিসনে, তা হলে পড়ে যাব।
পার্ব্বতী প্রাণপণে টানিয়া ধরিয়া রহিল। দেবদাস সেইটা ধরিয়া একটা নোনাডালে পা রাখিয়া, ছিপ কাটিতে লাগিল। পার্ব্বতী নীচে হইতে কহিল, দেবদা, পাঠশালে যাবে না?
না।
জ্যাঠামশাই তোমাকে পাঠিয়ে দেবেন।
বাবা আপনি বলেচেন, আমি আর ওখানে পড়ব না। বাড়িতে পণ্ডিত আসবে।
পার্ব্বতী একটু চিন্তিত হইয়া উঠিল। পরে বলিল, কাল থেকে গরমের জন্য আমাদের সকালবেলা পাঠশালা বসে, আমি এখনি যাব।
দেবদাস উপর হইতে চক্ষু রাঙাইয়া বলিল, না, যেতে হবে না।
এই সময়ে পার্ব্বতী একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল,—অমনি বাঁশের ডগা উপরে উঠিয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবদাস নোনাডাল হইতে নীচে পড়িয়া গেল। বেশী উঁচু ছিল না বলিয়া তেমন লাগিল না, কিন্তু গায়ে অনেক স্থানে ছড়িয়া গেল। নীচে আসিয়া ক্রুদ্ধ দেবদাস একটা শুষ্ক কঞ্চি তুলিয়া লইয়া পার্ব্বতীর পিঠের উপর, গালের উপর, যেখানে-সেখানে সজোরে ঘা-কতক বসাইয়া দিয়া বলিল, যা, দূর হয়ে যা।
প্রথমে পার্ব্বতী নিজেই লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু যখন ছড়ির পর ছড়ি ক্রমাগত পড়িতে লাগিল, তখন সে ক্রোধে ও অভিমানে চক্ষু দুটি আগুনের মতো করিয়া কাঁদিয়া বলিল, এই আমি জ্যাঠামশায়ের কাছে যাচ্ছি—
দেবদাস রাগিয়া আর এক ঘা বসাইয়া দিয়া বলিল, যা, এখনি বলে দিগে যা—বয়ে গেল।
পার্ব্বতী চলিয়া গেল। যখন অনেকটা গিয়াছে, তখন দেবদাস ডাকিল, পারু!
পার্ব্বতী শুনিয়াও শুনিল না—আরও দ্রুত চলিতে লাগিল। দেবদাস আবার ডাকিল, ও পারু, শুনে যা না!
পার্ব্বতী জবাব দিল না। দেবদাস বিরক্ত হইয়া, কতকটা চিৎকার করিয়া, কতকটা আপনার মনে বলিল, যাক—মরুক গে।
পার্ব্বতী চলিয়া গেলে, দেবদাস যেমন-তেমন করিয়া দুই-একটা ছিপ কাটিয়া লইল। তাহার মনটা বিগড়াইয়া গিয়াছিল। কাঁদিতে কাঁদিতে পার্ব্বতী বাড়ি ফিরিয়া আসিল। তাহার গালের উপর ছড়ির দাগ নীল হইয়া ফুলিয়া রহিয়াছে। প্রথমেই ঠাকুরমার চক্ষে পড়িল। তিনি চেঁচাইয়া উঠিলেন,—ওগো, মা গো, কে এমন করে মারলে পারু?
চোখ মুছিতে মুছিতে পার্ব্বতী কহিল, পণ্ডিতমশাই।
ঠাকুরমা তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, চল তো, একবার নারাণের কাছে যাই, দেখি সে কেমন পণ্ডিত! আহা—বাছাকে একেবারে মেরে ফেলেচে!
পার্ব্বতী পিতামহীর গলা জড়াইয়া কহিল, চল।
মুখুয্যে মহাশয়ের নিকট আসিয়া পিতামহী পণ্ডিত মহাশয়ের অনেকগুলি পুরুষের উল্লেখ করিয়া তাহাদিগের পারলৌকিক অশুভ ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন এবং খাদ্যদ্রব্যেরও তেমন ভাল ব্যবস্থা করিলেন না। শেষে স্বয়ং গোবিন্দকে নানামতে গালি পাড়িয়া বলিলেন, নারাণ, দেখ তো মিনসের আস্পর্ধা! শুদ্দুর হয়ে বামুনের মেয়ের গায়ে হাত তোলে! কি করে মেরেচে একবার দেখ। বলিয়া গালের উপর নীল দাগগুলা বৃদ্ধা অত্যন্ত বেদনার সহিত দেখাইতে লাগিলেন।
নারায়ণবাবু তখন পার্ব্বতীকেই প্রশ্ন করিলেন, কে মেরেচে পারু?
পার্ব্বতী চুপ করিয়া রহিল। তখন ঠাকুরমাই আর একবার চিৎকার করিয়া বলিলেন, আবার কে! ঐ গোঁয়ার পণ্ডিতটা।
কেন মারলে?
পার্বতী এবারও কথা কহিল না। মুখুয্যেমশাই বুঝিলেন, কোন দোষ করার জন্য মার খাইয়াছে—কিন্তু এরূপ আঘাত করা উচিত হয় নাই, প্রকাশ করিয়া তাহাই বলিলেন। শুনিয়া পার্বতী পিঠ খুলিয়া বলিল, এখানেও মেরেচে।
পিঠের দাগগুলা আরও স্পষ্ট, আরো গুরুতর। তাই দু’জনেই নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া গেলেন। পণ্ডিত মহাশয়কে ডাকিয়া কৈফিয়ত তলব করিবেন, মুখুয্যে মহাশয় এরূপ অভিসন্ধিও প্রকাশ করিলেন; এবং স্থির হইল যে, এরূপ পণ্ডিতের নিকট ছেলেমেয়ে পাঠান উচিত নহে।
রায় শুনিয়া পার্ব্বতী খুশি হইয়া ঠাকুরমার কোলে চড়িয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বাটীতে পৌঁছিয়া পার্ব্বতী জননীর জেরায় পড়িল। তিনি ধরিয়া বসিলেন, কেন মেরেচে বল্?
পার্ব্বতী বলিল, মিছিমিছি মেরেচে।
জননী কন্যার খুব করিয়া কান মলিয়া দিয়া বলিলেন, মিছিমিছি কেউ কখন মারে?
দালান দিয়া সেই সময়ে শাশুড়ি যাইতেছিলেন, তিনি ঘরের চৌকাঠের কাছে আসিয়া বলিলেন, বৌমা, মা হয়ে তুমি মিছিমিছি মারতে পার, আর সে মুখপোড়া পারে না?
বৌমা বলিল, শুধু-শুধু কখনো মারেনি। যে শান্ত মেয়ে—কি করেচে, তাই মার খেয়েচে।
শাশুড়ি বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আচ্ছা, তাই না হয় হলো, কিন্তু ওকে আর আমি পাঠশালে যেতে দেব না।
একটু লেখাপড়া শিখবে না!
কি হবে বৌমা? একটা-আধটা চিঠিপত্র লিখতে পারলে, দু’ছত্র রামায়ণ-মহাভারত পড়তে শিখলেই ঢের। পারু কি তোমার জজিয়তি করবে, না উকিল হবে?
বৌমা অগত্যা চুপ করিয়া রহিল। সেদিন দেবদাস বড় ভয়ে-ভয়েই বাড়িতে প্রবেশ করিল। পার্ব্বতী যে ইতিমধ্যে সমস্তই বলিয়া দিয়াছে, তাহাতে তাহার আর কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। কিন্তু বাড়ি আসিয়া যখন তাহার অণুমাত্র আভাসও প্রকাশ পাইল না, বরঞ্চ মায়ের কাছে শুনিতে পাইল—আজ গোবিন্দ পণ্ডিত পার্ব্বতীকেও অত্যন্ত প্রহার করিয়াছে, তাই আর সে পাঠশালায় যাইবে না—তখন আনন্দের আতিশয্যে তাহার ভাল করিয়া আহার করাই হইল না; কোনমতে নাকে-মুখে গুঁজিয়া পার্ব্বতীর কাছে ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, তুই আর পাঠশালে যাবিনে?
না।
কি ক’রে হ’ল রে?
আমি বললুম, পণ্ডিতমশায় মেরেচে।
দেবদাস খুব একগাল হাসিয়া, তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিয়া, মত প্রকাশ করিল যে, তাহার মতো বুদ্ধিমতী এ পৃথিবীতে আর নাই। তাহার পর ধীরে ধীরে সে পার্ব্বতীর গালের নীল দাগগুলি সযত্নে পরীক্ষা করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আহা!
পার্ব্বতী একটু হাসিয়া মুখপানে চাহিয়া বলিল, কি?
বড় লেগেচে, না রে পারু?
পার্ব্বতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুঁ।
আহা, কেন অমন করিস, তাই তো রাগ হয়—তাই তো মারি।
পার্ব্বতী চোখে জল আসিল; মনে ভাবিল—জিজ্ঞাসা করে, কি করি? কিন্তু পারিল না।
দেবদাস তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল, আর অমন করো না, কেমন?
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
দেবদাস আর একবার তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিয়া কহিল, আচ্ছা—আর কখনও তোকে আমি মারব না।
Comments
Post a Comment